মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার হলো ‘বিশ্ব মা দিবস’। পৃথিবীর সবচেয়ে দৃঢ় সম্পর্কের নাম ‘মা’। সবচেয়ে পবিত্র ও মধুর শব্দের নাম ‘মা’। যদিও মাকে ভালোবাসা-শ্রদ্ধা জানানোর কোন দিনক্ষণ ঠিক করে হয় না। তবুও মাকে গভীর মমতায় স্মরণ করার দিন আজ। জগতে মায়ের মতো এমন আপনজন আর কে আছেন! তাই প্রতি বছর এই দিনটি স্মরণ করিয়ে দেয় প্রিয় মমতাময়ী মায়ের মর্যাদার কথা।
মাকে ভালোবাসা আর তার প্রতি হৃদয় নিংড়ানো শ্রদ্ধার বিষয়টি পবিত্র ধর্মগ্রন্থগুলোতে অত্যধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বিশ্ব মা দিবসের ইতিহাস শতবর্ষের পুরনো। যুক্তরাষ্ট্রে আনা জারভিস নামের এক নারী মায়েদের অনুপ্রাণিত করার মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্য সচেতন করে তুলতে উদ্যোগী হয়েছিলেন।
১৯০৫ সালে আনা জারভিস মারা গেলে তার মেয়ে আনা মারিয়া রিভস জারভিস মায়ের কাজকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য সচেষ্ট হন। ওই বছর তিনি তার সান ডে স্কুলে প্রথম এ দিনটি মাতৃ-দিবস হিসেবে পালন করেন। ১৯০৭ সালের এক রোববার আনা মারিয়া স্কুলের বক্তব্যে মায়ের জন্য একটি দিবসের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করেন। ১৯১৪ সালের ৮ মে মার্কিন কংগ্রেস মে মাসের দ্বিতীয় রোববারকে মা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এভাবেই শুরু হয় মা দিবসের যাত্রা।
আমার জন্য প্রতিটি দিবসই আমার মায়ের জন্য শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় পরিপূর্ণ। বাবাকে নিয়ে আমার অনেক গল্প-কবিতা লেখা থাকলেও ‘মা’কে নিয়ে তেমন লেখা হয়নি। তবে কয়েক বছর আগে একটি ইংরেজী গল্প ‘My mom only had one eye’ এর ছায়া অবলম্বনে আমার নিজের মতো করে তিন পর্বের একটি ছোটগল্প এ দেশীয় প্রেক্ষাপটে লিখেছিলাম। আক্ষরিক অনুবাদ না করে কল্পনায় নিজের থেকে কাহিনীর প্রয়োজনে কিছু সংযোজন করেছি। আজ সকল মায়েদের প্রতি আমার ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা জানিয়ে তিন পর্বের ছোটগল্পটি আরও একবার শেয়ার করলামঃ-
________________
১.
প্যাকেটটা একটু আগে গেট থেকে দিয়ে গেলো। আমার মেয়েদের পাঠানো ভালোবাসা। হ্যাঁ। ভালোবাসা যখন অনুভবের বিষয় থাকে না, তখন সেটা দেখানোর ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। বৃদ্ধাশ্রমের আপাত নিরাপদ কক্ষে বসে ভাবছি আমি শিহাব। জীবনের এই মোড়টিতে এসে ফেলে আসা পেছনের জীবন, ছানি পড়া ডান চোখের ঝাপসা জীবনের মত অস্পষ্ট.. অবোধ্য অনুভবে অসার অনুভূত হয়। যে চোখটি আমার নিজের নয়, সেটি দিয়েই সব কিছু দেখি আজকাল। আর দেখারই বা রয়েছে কি? এই যে, দুই মেয়ে বিশেষ বিশেষ দিনে ভালোবাসা পাঠায়.. সাত সমুদ্র আর তের নদী পার হয়ে প্যাকেটবন্দী ভালোবাসা বাসি হয়ে কাছে আসে আমার!
আদৌ কাছে আসে কী?
নাহ! কেবলি সামনে আসে।
সামনের আয়নায় নিজেকে দেখি। যার যার জীবনে অভ্যস্ত মেয়েরা নিজেদের কাছের মানুষদের নিয়ে সুখী হতে চাইল। দেশের বাইরে তাদের আলাদা ভূবনে, ওদের মা চলে যাবার পর, কেন জানি নিজেকে ওদের সাথে মানাতে চাইলাম না। একজন মহিলা আর একটি চোখ, আক্ষরিক অর্থেই আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিল, সেই ছেলেবেলা থেকেই। তখন তাড়না ছিল অবচেতন মনে। তবে এর আসল অনুভব হলো বিয়ের আরো অনেক পরে। সবকিছু মিলিয়ে বউটা একা রেখে যাবার পর, মেয়েদের কাছে একজন বাবার বাবা থাকাটা ম্লান হতে দেখি.. অনুভবও করি। আর সেই পিছু তাড়া করা অনুভব তখন তীব্র হতেই, নিজের একসময়ের চাকরীর সুত্রে এই আশ্রমের সাথে ঝুলে থাকা লিংকের সুবিধাটুকু কাজে লাগিয়ে, নিজের জন্য এই আপাত নিরাপদ জায়গাটিতে ঠাঁই নিয়েছি। এদের গ্রুপে চাকরি করতাম আমি একসময়।
মেয়েদের পাঠানো গিফটের ওপর হাত বুলিয়ে বাবু দুটিকে অনুভব করতে থাকি আমি.. একজন বাবা! দৃষ্টি আমার দেয়ালের আয়নায়.. সেখানে পরিচিত শিহাবের অপরিচিত এক চোখের ভেতরে তাকিয়ে থেকে এক বাবা পেছনে হারাতে থাকেন। সময়ের এক একটি লেয়ার দ্রুত সব অনুভব সমেত বাবার সামনে পলকের তরে থেমে সামনে আগায়! বাবা পিছায়.. বাবা থেকে স্বামী.. স্বামী ব্যাচেলর যুবক.. এভাবে কখন যেন স্কুলের মাঠে বন্ধুদের সামনে দাঁড়ানো সেই বাবুবেলায় ফিরে যায়! সেখানে একজন মহিলা আমার সামনে। মুখোমুখি একই ভূবনে একমাত্র সংগী এমন দুজন মানব-মানবী।
নিজের মনে ভাবনার ভ্রান্তিবিলাসে ডুবে থাকি ষাটোর্ধ একজন আমি। একজন বাবা তার বাবুবেলায় ফিরে গিয়ে, নিজের সাথে কথা বলেন। যে মহিলাটির সামনে মুখোমুখি দাঁড়ানো আমি, সেই মহিলাটি আমার মা ছিলেন!
২.
এক প্রাইমারি স্কুলের মাঠে মুখোমুখি আমি একজন মহিলার। একজন ছেলে তার মায়ের। তখন ক্লাশ ওয়ানে পড়ি আমি। ক্লাশ ওয়ান পড়ুয়া আমি প্রচন্ড জেদে ফেটে যাচ্ছি ভিতরে ভিতরে। সামনে দাঁড়ানো মহিলাটিকে আমি জ্ঞান হবার পর থেকে বুঝতে যখন শিখেছি, তখন থেকেই কেন জানি ঘৃণা করে আসছি। যদিও এই পৃথিবীতে কেবল এই মা-ই আমার একমাত্র আপনজন। আমার যখন এক বছর বয়স, তখন বাবা অন্য এক মহিলার প্রেমে পড়ে মাকে ছেড়ে চলে যায়। সেই থেকে মা আজ পর্যন্ত আমাকে আগলে রেখেছেন। আমরা যে বস্তিতে থাকি, আমার স্কুল সেখান থেকে একটু সামনে। বাবা মাকে ছেড়ে চলে যাবার পর, মা এই স্কুলের বোর্ডিং এ থাকা শিক্ষক এবং ছাত্রদের জন্য রান্না করে দেবার কাজ শুরু করেন।
মায়ের একটি চোখ নেই। এজন্য সবাই আমাকে কানার ছেলে বলে ডাকে। সেজন্যই মাকে আমি ঘৃণা করি। কেবল এই একটি সম্বোধনের জন্যই পৃথিবীর সব থেকে প্রিয় মানুষটি আমার কাছে সব চেয়ে ঘৃন্য মানুষে পরিণত হয়েছে। মায়ের দিকে তাকিয়ে থেকে আমার গত দিনের কথা মনে পড়ে। গতকাল ছিল প্যারেন্টস ডে। সবার বাবা-মায়েরা স্কুলে এসেছিলেন। কত আনন্দ। কিন্তু আমি সারাটিক্ষণ আল্লাহ আল্লাহ করেছি, মা যেন এখানে না আসেন। কিন্তু আল্লাহ আমার বাবু মনের প্রার্থনা কেন জানি শুনলেন না। মা এলেন। অন্যদের পাশে গিয়ে বসলেন। একটা ঘোরের মধ্যে সময়গুলি কিভাবে যেন কেটে গেল।
অন্যদের সাথে মা চলে গেলে সেদিন খেলার মাঠে বন্ধুদের একজন বললো, ’এ্যাই, তোর মায়ের এক চোখ নাই। তুই কানা বগীর ছা।‘ তার সাথে অন্যরাও তাল দেয়। সবাই আমাকে ঘিরে গোল হয়ে বলতে থাকে, ‘কানা বগীর ছা’ ‘কানা বগির ছা’। সেই সময়টায় আমার মনে হচ্ছিল মাটি ফাঁক হয়ে যাক। আমি যদি এই মুহুর্তে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারতাম! একই সাথে মনে এটাও জাগল, ‘মা কেন অদৃশ্য হয়ে যায় না আমার জীবন থেকে?’
আজ স্কুল মাঠে একা মাকে সামনে পেয়ে সব কিছু মনে পড়ে যায়। একটা নিস্ফল ক্রোধ আমার বাবু মনের এপিঠ-ওপিঠ ঘুরে ঘুরে পাক খেতে থাকে। মায়ের একমাত্র চোখের দিকে তাকিয়ে আমি হিসহিস করে বলি, ‘তুমি সবার সামনে আমাকে জোকার বানাও কেন? তোমাকে দেখে সবাই হাসে.. বুঝ না তুমি? কেন আসো আমার স্কুলে? তুমি মরতে পার না?’
মা চুপচাপ সব শুনলেন। কিছু বললেন না। দীর্ঘশ্বাসও ফেললেন না কিংবা গোপনও করলেন না। শুধু এক চোখে হৃদয়ের সকল মমতাটুকু এনে আমাকে ছুঁয়ে গেলেন! আমি প্রচন্ড রেগে ছিলাম, তাই এইমাত্র মাকে কি বললাম, সেটা আমার বাবু মনের অনুভবে এলো না।
সেদিন থেকে আমার ভেতরে একটা জেদ চাপে। আমি মায়ের জীবন থেকে, যেখানে মাকে সবাই চেনে-জানে, সেই এলাকা থেকে এমনকি মায়ের সাথে যে ঘরটিতে আমি থাকি, সেখান থেকে অনেক দূরে চলে যেতে চাইলাম। একটা তাড়না আমাকে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত কঠোর অধ্যবসায়ে নিমজ্জিত করায়। পড়ালেখা ছাড়া আর কোনো দিকে আমার মনযোগ থাকে না। আর এই সবকিছু কেবলি একজন এক চোখা মা’র ছেলে হিসেবে নিজেকে দেখাতে না চাওয়ার জন্যই.. কারো কাছ থেকে ‘কানা বগীর ছা’ সম্বোধন যাতে শুনতে না হয়, সেজন্যই করি আমি।
পরবর্তী বছরগুলোতে মায়ের সাথে থেকেও যেন একজন ‘আউটসাইডারে’ পরিণত হই আমি। এভাবে স্কুলের গন্ডী পার করে কলেজে পা রাখি। সেখানে অসাধারণ রেজাল্ট করার কারণে স্কলারশিপ পাই।
দেশের বাইরে এক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য দেশ ছেড়ে যাবার দিনটিও একদিন এসে যায়। যাবার দিনেও সেই একচোখা মহিলা আমার পিছু ছাড়েনি। বিমানবন্দরে বিদায় দিতে এসে এক পাশে অন্যদের থেকে দূরে দাঁড়িয়ে রইলেন। আমি একবারও তার দিকে ফিরে তাকালাম না। বন্ধু-বান্ধবদের সাথে মৃদু স্বরে কথা বলতে বলতে একসময় ডিপারচার লাউঞ্জে ঢুকে গেলাম সেই মহিলার সামনে দিয়ে।
একজন মা বিমানবন্দরে একজন অচ্ছুৎ হয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকেন দীর্ঘক্ষণ! তাঁকে সচকিত করে যখন বোয়িং ৭৪৭ রানওয়ে ত্যাগ করে, তখনো তার সম্বিত ফিরে না। একজন মা যখন সন্তানের কাছে সামান্য একটি অঙ্গহানির কারণে মায়ের দরজা হারিয়ে ফেলেন, তখন আক্ষরিক অর্থে একজন মা কি আসলেই মা থাকেন?
৩.
দেশের বাইরে আমার সময় কেটে যাচ্ছিল এক অন্য আবহে। আমার নতুন বন্ধু হলো। এদের ভেতরে একজন ‘প্রিয় বন্ধু’ও হলো। আমার জীবনকে নতুন উদ্যমে প্রেরণা দিতে সে আমার হাত ধরলো। আমাদের ভেতর ভালোলাগা গড়ে উঠলো। তা একসময় ভালোবাসায় রুপ নিলো। আর কখন যে ভালোবাসা পুড়ে পুড়ে প্রেম হলো, আমি নিজেই জানলাম না। তবে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে এই মেয়েটি আমার পুরো স্বত্বা জুড়ে রইলো। আমাদের দু’জনের পড়া-লেখা শেষ হলো। দুজনেই ডিগ্রী নিয়ে দেশে ফিরতে উদগ্রীব হলাম।
আমি কখনো আমার হবু জীবনসঙ্গিনীকে আমার মা’র সম্পর্কে কিছুই বললাম না। সে একবার আমার রক্তের সম্পর্কের কে কে আছে জানতে চাইলে, আমি বললাম কেউ নেই আমার। আমি একা। তখন ভুলেও আমার এক চোখা মাকে একটুও মনে পড়ল না।
দেশে ফিরলাম দু’জন। আমার প্রিয় বন্ধুর বাবা-মা এয়ারপোর্টে আমাদেরকে রিসিভ করলেন। তাদের বাসায়ই উঠলাম। আমার সম্পর্কে তারাও একই প্রশ্ন জানতে চাইলেন। আমার উত্তরও ছিল একই। আমার হবু শ্বশুরের উচ্চবিত্ত আর চাকচিক্য আমাকে আরো ধাঁধিয়ে দিলো। খুব দ্রুতই আমি একটা ভালো জব অফার গ্রহণ করলাম।
আমাদের দু’জনের বিয়ে হলো। সময় ফুরফুরে মেজাজে বয়ে যেতে লাগল। আমি আমার মা’কে একবারও দেখতে গেলাম না। দু’জনে ভিন্ন দুই শহরে থাকলেও এতটা দূরত্ব ছিল না যে, আমি যেতে পারতাম না। কিন্তু দূরত্ব ছিল আমার মনে। আমার চাওয়া-পাওয়ার প্রাণকেন্দ্রের ইচ্ছেপালকে ধুলো জমেছিল। তাই মনের অগোচরেও আমি সেই মহিলাকে নিয়ে একবারও ভাবলাম না। সময় বয়ে গেলো। আরো ধুলোর আস্তরণ পড়ল আমার মনের আরশিতে একজন এক চোখের গরীব মহিলাকে কেন্দ্র করে।
আমার দুই কন্যা একে একে পৃথিবীতে এলো। তারা বুঝার মত বড়ও হলো। আমার অনেক উন্নতি হলো। আমি একটা চমৎকার বাড়ি বানালাম। গাড়ি কিনলাম। আমার ভূবন একদা’র আমার বসবাসের সেই বস্তি জীবনের তুলনায় যোজন যোজন দূরত্বের ছিল।
একদিন সাপ্তাহিক বন্ধের দিনে আমি মেয়েদের নিয়ে বাসায় আমার একান্ত মুহুর্তগুলি কাটাচ্ছিলাম। হঠাৎ ডোরবেলের আওয়াজ। সোফায় দুই মেয়েকে পাশে নিয়ে বসে মৃদু খুনসুটিতে ব্যস্ত ছিলাম। বড় মেয়ে দরজা খুলতে গেলে ছোটজনও পিছু নিলো। দরজা খুলেই বড় মেয়ে চিৎকার করে পিছিয়ে এলো। ওর দেখাদেখি ছোটজনও একই কাজ করতেই, আমি সামনে আগালাম। উন্মুক্ত দরজার ওপাশে আজ এতগুলি বছর পরে আমি সেই মহিলাকে দেখলাম! বয়সের ভারে আরো নুয়ে পড়েছে। তার জীর্ণ মলিন পরিচ্ছদ আরো মলিন হয়েছে। শূন্য চোখের গহ্বরটি তাঁকে আরো ভয়ংকর কদাকার করে তুলেছে। আসলেই হঠাৎ দেখে যে কেউই ভয় পাবে।
তবে কয়েকমুহুর্ত পার হলে, আমার মেয়েরা সাহস করে সামনে এলো এবং এবারে ভয়ের পরিবর্তে তারা সেই কদাকার মহিলার প্রতি উপহাসের হাসি হাসলো। আমার ভেতরে কিছু একটা কি যেন ছিড়ে গেলো। আমি ভয়ংকর উত্তেজিত হয়ে উচ্চস্বরে তাঁকে বললাম, ‘তোমার এত বড় সাহস কি করে হলো আমার বাসায় আসার? আমার মেয়েদেরকে তুমি ভয় পাইয়ে দিয়েছে, এখুনি এখান থেকে বের হয়ে যাও!’
সেই মহিলা তার ভালো চোখটি দিয়ে এক পলক আমাকে এবং আমার মেয়েদেরকে দেখলো। এই প্রথম সে আমার মেয়েদেরকে দেখছে। আমাকেও আজ এতগুলি বছর পরে দেখলো। মুখে লজ্জার হাসি ফুটিয়ে সে বললো বড্ড শান্ত স্বরে, ‘ওহ! আমাকে মাফ করবেন, আমি ভুল ঠিকানায় এসে পড়েছি।‘ এক মুহুর্তও সে আর না দাঁড়িয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলো। একবারও পেছনে ফিরলো না।
আরো কয়েকমাস পরে, আমার সেই ছেলেবেলার স্কুল থেকে একটি চিঠি এলো আমাদের ব্যাচের ‘রি-ইউনিয়নের’ দাওয়াত নিয়ে। আমি কোনো কিছু চিন্তা না করেই সেখানে যাবার ব্যাপারে মনঃস্থির করলাম। আমার বউকে মিথ্যে বললাম যে, অফিসের কাজে আমাকে ‘অমুক’ শহরে যেতে হবে।
নির্দিষ্ট দিনে আমি ‘রি-ইউনিয়নে’ অংশ নিলাম। ছেলেবেলার বন্ধুদের সাথে নিয়ে একটা দিন এবং রাত চমৎকার কেটে গেলো। পুরনো স্মৃতিতে রোমন্থনযোগ্য অনেক কিছু এলেও আশ্চর্যজনকভাবে আমার মা একবারও আমার মনে এলো না। হাতে অনেক সময় আছে ফিরবার। তাই শ্রেফ কৌতুহলের বশবর্তী হয়ে আমি আমার ছেলেবেলার সেই পুরনো বসবাসের জায়গায় গেলাম। আমাদের প্রতিবেশী কয়েকজন তখনো বেঁচে ছিলেন। ওনারা আমাকে চিনলেন। এদের ভেতর থেকে একজন বয়স্ক মানুষ এগিয়ে এলেন। আমাকে চিনতে পেরে তিনি আবার তার ঘরের ভেতরে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর, একটা মুখবন্ধ খাম হাতে নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। আমাকে চিঠিটি দিয়ে জানালেন যে, গত রাতে আমার মা- সেই এক চোখা মহিলা মারা গেছেন। এলাকার সবাই রাতেই শেষকৃত্য সম্পন্ন করেছেন। শুনে আমার ভেতরে কোনো ধরণের অনুভূতি জাগলো না। আমার চোখ দিয়ে এক ফোঁটা অশ্রুও বের হলো না।
আমি আমার বর্তমান জীবনের উদ্দেশ্যে ফিরে যেতে আমার রাস্তায় ফিরে চলি হেঁটে হেঁটে। আমার হাতে সেই মহিলা যিনি আমার গর্ভধারিনী ছিলেন, তার লেখা চিঠি! আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত খামের মুখ খুললাম। অস্পষ্ট হলেও আমার একদার পরিচিত হস্তাক্ষর মুহুর্তে আমার দৃষ্টিগোচর হলো। সেই মহিলা আমাকে উদ্দেশ্য করে লেখেছেন-
‘প্রিয় বাবুটা আমার!
আমি সবসময়েই তোমাকে ভেবেছি। প্রতিটা মুহুর্ত তোমার মঙ্গলচিন্তায় ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছি। আমি আবারো দুঃখ প্রকাশ করছি বাবুটা, সেদিন ওভাবে না জানিয়ে তোমার বাড়িতে গিয়ে তোমার মেয়েদেরকে ভয় পাইয়ে দেবার জন্য।
তুমি ‘রি-ইউনিয়নে’ আসবে জেনে আমি খুবই খুশী হয়েছিলাম। কিন্তু আমি এতটা-ই অসুস্থ ছিলাম যে, ঐ অনুষ্ঠানে গিয়ে তোমার সাথে দেখা করার মত শক্তি আমার শরীরে ছিল না। আমি অত্যন্ত দুঃখিত বাবুটা যে, সেই ছেলেবেলা থেকে কেবল আমার জন্য তোমাকে অন্যের কাছে হাসির পাত্র হতে হয়েছে।
যে কথা কখনো তোমাকে বলিনি প্রিয় বাবুটা আমার, আজ বলছি শোন। একেবারে বাবু বয়সে এক দুর্ঘটনায় তোমার একটা চোখ নষ্ট হয়ে যায়। একজন মা হিসেবে আমি এটা কল্পনাও করতে পারিনি যে, একটা মাত্র চোখ নিয়ে তুমি বড় হবে! তাই আমার একটা চোখ তোমাকে দিয়েছিলাম তখন।
আমি অত্যন্ত গর্ববোধ করেছিলাম যে, আমার দেয়া চোখ দিয়ে আমার ছেলে আমার জন্য সমগ্র বিশ্বকে দেখবে! আমি যখন থাকবো না, তখনও আমি এই পৃথিবীর আলো-বাতাস দেখবো-অনুভব করবো! আসলে সেটাই কি হচ্ছে না?
তোমার মেয়ে দুটি খুব সুন্দর! ওদের জন্য অনেক অনেক আদর রইলো। দুঃখ তোমার বউকে দেখতে পেলাম না। ওকেও আমার ভালোবাসা জানিও।
আমার হৃদয়ের সকল ভালোবাসা তোমার জন্য রেখে গেলাম প্রিয় বাবুটা!
তোমার মা।‘
আমি শেষ লাইনটা পড়ার পর যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম, রাস্তার মাঝামাঝি সেখানেই স্থাণুর মত অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। রাস্তায় অপেক্ষামান গাড়ির বিকট আওয়াজ আমাকে সরতে বলছিল, আমি কিছুই শুনতে পেলাম না। শেষে এক পথচারী এসে টেনে আমাকে ফুটপাতে নিয়ে রেখে এলেন।
আমার মন পুড়ে যাচ্ছিল.. কোথায় কোথায় যেন চিরে যাচ্ছিল। হাত থেকে সেই মহিলার লেখা চিঠিখানা বাতাস উড়িয়ে নিয়ে গেলেও আমি সেটা ধরার জন্য সামনেও আগাতে পারছিলাম না। এক অবোধ্য অনুভবে বিলীন হতে হতে আমার ভেতরে কেবলি এই কথাটিই বার বার বেজে চলছিল, ‘সেই মহিলা আমার মা ছিলেন!’ একজন এক চোখা মহিলা, যাকে আমি সারাটা জীবন ঘৃণাই করেছি কেবল। অথচ আমার জন্য শেষ সময় পর্যন্তও কেবল ভালোবাসাই রেখে গেছেন তিনি।
মায়েরা কি এমনই হয়?
…
সময়ের বুক থেকে আবারো নিজের ধুসর বর্তমানে ফিরে আসি আমি শিহাব। সেই বৃদ্ধাশ্রমের নিজের আপাত নিরাপদ কক্ষে। আয়নায় দেখা সেই অচেনা চোখটিকে আজ বড্ড চেনা লাগছে। ঐ চোখটি যে আমার মায়ের! একজন মায়ের চোখ কেমন হয়? অর্ধেক জীবন পার করেও সেটা আমার বুঝে আসেনি। যখন বুঝে এলো, তখন সেই বুঝ আমার কোনো কাজে এলো না।
কথায় বলে, ইতিহাস তার পুনরাবৃত্তি করে থাকে। আজ এক বৃদ্ধাশ্রমে একজন বাবা তার বিগত সময়ের ভুল ভাবনার খেসারত দিচ্ছেন বড্ড তীব্রভাবে। সব কিছু থেকেও আমার কিছুই নেই। অনুভবে রয়েছে, বাস্তবে কেবলি শূণ্যতা! যে শূণ্যতায় কখনো নিঃশেষ হয়েছে একজন এক চোখের মহিলা। জীবনভর ভালোবাসার প্রতিদানে সে কেবলি ঘৃনাই পেয়ে গেছে। তবুও শেষ সময় পর্যন্ত তার প্রিয় বাবুটার জন্য ভালোবাসাই রেখে গেছে সে।
বেলা শেষে কোনো প্রিয়জন ফিরে এসে ডাকবে আমায় কিংবা পাশে এসে নীরবে শুধু চলে যাওয়া প্রহরকে অনুভব করাবে, এমন কোনো অনুভবে আজকাল আমি উদ্দীপ্ত হই না। এ আমার নিজের কর্মফল.. আমি নিজেই অর্জন করেছি এই নিঃসঙ্গতা!
তাই আমাকে এভাবেই থাকতে হবে। আয়নায় দেখা আমার মায়ের চোখ আমার এই দুরবস্থায় কেন জানি ভিজে আসে। তার প্রিয় বাবুটার এই নিঃসঙ্গতা কেন জানি তাঁকে পীড়া দেয়। অসহ্য কষ্টকর মুহুর্তগুলিতে তাই যে চোখটি আমার নয়, সেটি কেঁদে চলে। আমার নিজের চোখটি অনেক আগেই কেন জানি নিষ্প্রাণ পাথরে পরিণত হয়েছে। তাই আমার অনুভূতি-অনুভব সকল ইচ্ছেপালকের নিউক্লিয়াস ইদানিং সেই একচোখা মহিলার আমায় ভালোবেসে দান করা চোখকে ঘিরেই চলতে থাকে…।
মূল গল্পঃ My mom only had one eye ‘র ছায়া অবলম্বনে লেখা।
#আমি_এবং_সেই_মহিলা_মামুনের_ছোটগল্প।
loading...
loading...
অণুগল্পটি আমি সামাজিক মাধ্যমে পড়েছি। আমার কাছে অসাধারণ লেগেছে।
loading...
ধন্যবাদ ভাইয়া।
ঈদের শুভেচ্ছা।

loading...